নিস্তব্ধ শহর, খোলা আকাশ, মসৃন ছাদ, ছাদে ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা তবে এখন বোধ করি পরছে না। চাঁদটা এখনো উঁকি দেয় নি, বা দিয়েছে হয়তো মেঘের বুকে মুখ লুকিয়ে। তবে শহরে চাঁদের অভাব হয় না। সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে শহুরে চাঁদ। নিদ্রাহীন দিয়ে চলেছে জোৎস্না। গাছপালা গুলো অবিরাম মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। উপর দিয়ে একটা বাদুড় ও উড়ে গেলো। আরে এ শহরেও বাদুর দেখা যায় তাহলে? গ্রামের বাড়িতে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিলো। ওটাতে প্রতি রাতেই দশ পনেরোটা বাদুর একসাথে ঝুলে থাকতো। চাঁদের আলোয় কিছুটা দেখা যেতো বৈকি তবে বেশি না। আমি ঘরে থাকা সিলভারের টর্চলাইট টা দিয়ে আলো ফেলতাম ওই গাছে। বাপরি কি মাথা ঘুরিয়ে চাওনি। ওমা একি সাথের আমগাছটায় একটা পেঁচাও দেখি বসে আছে! টর্চের আলো পড়তেই চোখ দুটো কেমন জ্বলে ওঠলো!
আজ বৃহস্পতিবার। জাফর চলে গেছে ওর ফুফুর বাড়িতে, আরজুঁ ও চলে গেছে বাড়িতে। বাসায় আমি একা। ক্লাস শেষ করে বাড়িতে এসে দেখি ছোট খালা পনেরো টা কল দিয়ে রেখেছে। আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম। ব্যাপার কি এতো বার কেন ফোন করল? আমিও তড়িঘড়ি করে ফোন দিলাম। বলল-
—শোন না এনামুল কাল তো শুক্রবার চলে আয় আমাদের বাড়ি, অনেক দিন তো আসা হয় না তোর, তাছাড়া মিথিলা আর মেশকাতুল বারবার তোর কথা বলছে, আর তুই এতক্ষন ফোন ধরিস নি কেন হুম?
—খালা, আমি ক্লাসে ছিলাম। মাত্র আসলাম, তুমি কি ভুলে গেছো যে আমার ক্লাস শুরু হয়ইতো একটা পনেরো তে। আর খালা আমি যেতে পারবো না আজকে।
— কেনো? কেন পারবি না? কালতো বন্ধই। গত সপ্তাহে বললাম আসলি না। বললি যে তোর বন্ধু একা থাকবে। বাসায় বেশি মেহমান ছিলো বিধায় তোর বন্ধুকে আসতে বলতে পারি নি। তুই তো জানিসই আমাদের রুমই দুইটা। তাছাড়া মিথিলার ফুফুরাও তো ছিল। কিন্তু আজ তো বাসা খালিই আছে। তুই ওকে নিয়ে চলে আয়।
— না খালা, আজ যাব না। রনি ভাইয়া বলেছে কাল ওনাদের বাসায় খেতে হবে। আমাকে দিয়ে মিল বন্ধ করিয়েছে। আর মেজো খালাও নাকি আসছে। তাই এই সপ্তাহেও যেতে পারবো না। তবে খালা সামনের সপ্তাহে নিশ্চয়ই যাবো।
খালা অনেকখন সাধাসাধি করে শেষে রেখে দিল। শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো, তাই গোসলটা সেরে নিলাম। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরেই গোসলটা করলাম।এখানের জায়গাটা কিছুটা গাছগাছালি বেশি। আর রুমের পাশেই রয়েছে বিশাল বাশঝাড়। তাই পানির ট্যাংক থাকে হিমশীতল। গোসল সেরে ফ্যানটা ছেড়ে কাঁথাটা নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
এই যা! ১০ টা বেজে গেলো! এদিকে আম্মু ও প্রায় বিশটার মতো কল দিয়ে রেখেছে। কি মুস্কিল! এখন কল দিলেই একগাদা কথা শুনাবে। আরে বাবা আমি যখন কল দিই তখন তো ধর না। কিন্তু নিজে একটাবার না পেলে রেগে যাও। আমি কি ঘুমাবোও না। যাই হোক বেসিনে যেতে যেতেই কল দিলাম।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, কতজা শোনানো শুরু।তবে আজ আম্মু কথা শোনালো না, কথা শোনলো আজিমে।
— হ্যাঁ, আমি কোন সময় থাইক্কা ফোন দিতাছি, ধরেন না কিরে? একশোটার মত মনে হয় কল দিছি, কই আছলেন হুম? খালি ঘুরাঘুরি, আর কয়দিন পরপর টাকা লাগব টাকা লাগব, বাইততে কল দিলে ধরত মনে থাকে না। হ্যালো! হ্যালো! আম্মা তোমার পুতে কল ধইরা ঘুমাই লাইছে মনে হয়।
আমি দাঁত ব্রাশ করছি আর হাসছি। পিচ্চিতো ভালাই কথা শিখেছে দেখছি।
— হ্যালো ভাইয়া! আপনের রক্তের গুরুপ কিতা?
আমিতো হকচকিয়ে গেলাম, ওয় আবার রক্তের গ্রুপ জানতে চাবে কেন? কোন সমস্যা হয় নি তো আবার!
এমনিতেই কিছুদিন আগে কাসপিয়ার বাচ্চাটা মারা গেছিলো। কাসপিয়া আমার চাচাতো বোন, আবার চাচাতো ভাইয়ের বউ হওয়ায় ভাবীও বলতে পারি। ওদের বিয়ে হয় প্রায় দের বছড় হয়ে গেছে। ভাইয়া প্রবাসে চলে যাবে তাই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংসারে নতুন মানুষের আগমনের জন্য এই অল্প বয়সেই এই সিদ্ধান্ত। বয়সটা ওর আমার থেকে মাস ছয়েকের বড়। আমাদের ক্লাসেই পড়তো। তবে দেহে ছিলো না একছটাক গোশত। এই শরীল নিয়ে গর্ভধারণ সত্যিই ঠিক ছিলো না। গত শুক্রবারে ভাইয়া বলল যে আমি তো চলে যাবো, তো যাওয়ার আগে যদি দেখে যেতাম অগমনী মানুষটা ছেলে না মেয়ে। তারওপর আজ স্বপ্নে দেখলাম একটা লাশ।
তো যেই ভাবা সেই কাজ। কসবা সদরে নিয়ে আল্ট্রাসনো করা হলো। প্রথমবার আসলো বাচ্চা মৃত! তারপর পর পর পাঁচবার আল্ট্রা করানো হলো, ফলাফল সেই একই। কাসপিয়া তো রীতিমতো কান্না জুড়ে দিলো। বাড়িতে ফোন দেওয়া হলো। জেঠা বলল যে কুমিল্লা নিয়ে আবার আল্ট্রা করানো হোক। এখানের টা বিশ্বাস নেই। আনা হলো মিশন হসপিটালে। এখানেও তাই। বেডে শিফট করা হলো পাঁচদিনের জন্য, এর মধ্যে বাচ্চা প্রসবের সম্ভাবনা আছে।
আমি বাড়ি থেকে এসব কোন খবর পাই নি, আসলে কয়েকদিন বাড়িতে ফোন দেয়া হয় নি। খবর শুনলাম সানজিদার কাছে। সানজিদাও আমাদের ক্লাস মিট ছিলো। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে আসলে ওর ফেসবুকে ঢুকা হয়। তো আমি অনলাইনে পেয়ে নক করলাম, অনেক কথাবার্তার পর বলল, কাসপিয়ার কি অবস্থারে?
আমি বললাম কেন কি হয়েছে? ও তো ভালই আছে দেখে আসলাম। আমিতো শুক্রবারেই এলাম কুমিল্লায়?
—শুক্রবার এসেছিস আর শুনিস নি কি হয়েছে? ওর তো শুক্রবারেই আল্ট্রাতে মৃত বাচ্চা ধরা পড়েছে। এখন নাকি কুমিল্লা আছে।
—বলিস কি? আমিতো এসব কিছুই শুনলাম না। দারা তো বাড়িতে কল দিয়ে নিই।
—তুই কি আর আগের তুই আছিস? তোর তো এখন টিকিটাও দেখা যায় না। যা তারাতাড়ি কল দে।
বাড়িতে কারোর মোবাইলেই কল ঢুকাতে পারলাম না। আসলে আমাদের এখানে নেটওয়ার্ক এর অনেক সমস্যা। তো সজীব আর আয়শাকে এসএমএস দিয়ে রেখেছিলাম যে কোন হসপিটালে কাসপিয়া আছে।
সেদিন সজীব এসএমএস দিল যে মিশনে আছে, তো গেলাম। আমি ছাত্র মানুষ, আর টিউশনি ও করি না, বাবার ঘাড়ে চেপেই খাই, তাও বোনকে দেখতে যাবো কিছু না কিছু তো নিতেই হবে। আমার তো আর নিজের বোন নেই, ওদেরকে নিজের বোনের মতোই দেখতাম। শেষে এক কেজি মাল্টা নিলাম, দাম নিলো আড়াইশো। এতো দাম হবে ভাবিনাই। যাইহোক ছয়টা মাল্টায় কেজি হয়ে গেলো। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। ধুর এই সামান্য জিনিস নিয়ে কিভাবে যাবো। তাও লজ্জার মাথা খেয়ে হাসপাতালে ঢুকলাম।
সজীব ও আছে এখানে। ওকে কল দেওয়ায় ও বারান্ধায় এসে আমাকে উপরে আসতে বলল।
গিয়ে দেখি কাসপিয়া ঘুমুচ্ছে। আরো তিনদিন হসপিটালে থাকতে হবে, এমনটাই নাকি বড় ডাক্তার বলে গেছেন। আমি ডাক দিলাম না। জেঠি বলল…
—বাবা আইছো। বসো খাটে বসো।
— কবে হলো আমিতো কিছুই শুনলাম না। কি হইছিল জেঠি?
তিনি একে একে সব বলতে লাগলেন। ও.টি থেকে যখন বাচ্চা নিয়ে সিস্টার রা বের হয় তখন তখনই কাসপিয়ার রোদন শুরু হয়।
— আরে আমার ময়না কইরে! ময়না! ও ময়না! আরে আমি কেমনে বাইত যায়াম রে! ও আল্লাহ রে! আম্মা আমার ময়না কি আমার কোলে আইব না গো। আম্মা!
কথা গুলো শুনে যেন আমার ও কান্না আসতে লাগলো। সজীবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। নিচে চা খেয়ে একটু হাটাহাটি করলাম। মনটা অস্থির হয়ে ছিল। যাইহোক পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক দেখে রাত ৯ টা নাগাদ বাসায় এসে পড়লাম। তারপর এগারোটায় কল দিয়ে শুনি বাচ্চা প্রসব হয়েছে। কাসপিয়াও মোটামুটি সুস্থ। বাচ্চা আগামীকাল সকালে নিয়ে যাবে। কাসপিয়াও যাবে দুপুর নাগাদ। কি মেয়েটা কি হয়ে গেলো। এই কয়দিনে ওকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। ও প্রভু! তুমি ওকে এ কোন পরীক্ষায় ফেললে?
— হ্যালো! ভাইয়া কথা বলেন না কিরে? আজকা আমার রক্তের গ্রুপ মাপছে। আমার এ পজিটিভ। আপনার টা কিতা?
— আমি বললাম আমার বি পজিটিব।
— হ্যাঁ? আমার লগে তো মিলল না!
—তোকে তো ওই গাঙ্গের থাইকা পাইয়া আনছে তাই তোর লগে আমার মিলে নাই। দে আম্মুর কাছে মোবাইল দে।
আম্মুর সাথে কথা বলে ফোন টা রাখলাম। এতক্ষনে বোধ হয় মেসের সবার খাবার হয়ে গেছে। তাও মিলটা আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি আজ আলুর ভর্তা ডাল। কি আর করা যা রাঁধে তাই খেতে হবে। নাহয় উপোশ। যাইহোক খাবার টা নিয়ে এসে খেয়ে নিলাম। আসলে ক্ষিদেও ছিলো প্রচণ্ড। তাই আলুভর্তাও যেন অমৃত মনে হলো।
—মন চাইতেছে একটু চা খেতে পারলে ভালো হতো। হিটারটা এনেছি শুক্রবারে।। এখন পর্যন্ত কফি আর দুধ খেয়েছি, চা খাইনি।আজ ভাবলাম চা খাবো। ভাবনা মতো দোকানে গিয়ে নগদ থেকে শেষ সম্বল ২০০ টাকা ওঠিয়ে একটা ইস্পাহানি মির্জাপুর টি ব্যাগের প্যাকেট আর একটা মার্কস দুধের প্যাকেট নিলাম। এসে রুমটা একটু গুছিয়ে নিলাম। পানিটা গরম করে তাতে দুটু প্যাকেট ডুবিয়ে দিই। তিনটা বগবগ করে পাক ওঠার পর হিটার টা বন্ধ করে চিনি ও ধুদ মেশালাম। একটু মুখে দিয়ে দেখি বাহ অনেক মজা হয়েছে তো। সত্যিই নিজের হাতে চা বানাইনি অনেক দিন হয়ে গেলো। চা টা সত্যিই অসাধারণ ছিলো!
চা টা একহাতে নিলাম আর জহির রায়হানের লিখা “শেষ বিকেলের মেয়ে” বইটা নিলাম আরেক হাতে। চিলেকোঠার লাইট টা জ্বলানো ছিল। ভাবলাম চা খেতে খেতে বইটা একটু পড়া যাক। কিন্তু তখনি বিদ্যুৎ টা চলে গেল। ইদানীং বিদ্যুতের এই ঝামেলাটা আর ভালো লাগছে না। কি যে যন্ত্রণাদায়ক সময়ে চলে যায়।
বই টা আর পড়া হলো না। ছাদে হাটা শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বড্ড ভয় লাগতো এই ছাদে, ছাদের নিচের কবরস্থান আর ছাদের গা ঘেসে বাশঝাড়। কি যে ভয়ানক পরিস্থিতি। চাঁদের আলো ছাড়া যেন পাতালপুরি। তিনতলা বাসা হওয়ায় এখানে সেই শহুরে চাঁদের আলো আসে না। সর্বদাই অন্ধকার। তবে এখন আর ভয় লাগে না৷ থাকতে থাকতে অভ্যেশ হয়ে গেছে। এখন ভালো না লাগলে রাত দু টো তিনটে বাজেও ছাদে গিয়ে বসে থাকি।
একি! এ কে? ও এখানে কি করছে? রাত তো প্রায় ২ টা বাজে! এই মেয়ে এত রাতে ছাদে কি করছে? ও নির্বিকার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর দেখছিলো আমার চা খাওয়া। চা টা শেষ হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু ভয়ে আর শিহরণে আমি চায়ের কাপেই মুখ লুকিয়ে রইলাম।