fbpx
সংবাদ শিরোনাম

রুশ সাহিত্যের অগ্রপথিক; যার লেখা নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বকে

                                           
সাঈদ ইব্রাহিম রিফাত
প্রকাশ : সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১
রুশ সাহিত্যের অগ্রপথিক; যার লেখা নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বকে

সময়ের বিবর্তনে সংগ্রামীদের ইতিহাস পৃথিবী সবসময় মনে রেখেছে; এমনসব মানুষদের দিয়েছে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। তবে এই সংগ্রামীদের বেশিরভাগেরই জীবন গেছে কারাগারের গরাদে বন্দি হয়ে হয়ে, দুঃশাসকের কড়াল থাবায় প্রতিনিয়ত হয়েছেন নিষ্পেষিত।

বিশ্বখ্যাতি যখন পেয়েছেন তখন জীবনের সুবর্ণসময়টুকুর অনেকখানি শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেকে তো জীবদ্দশাতেই সেই খ্যাতির বিন্দুমাত্র দেখে যেতে পারেন নি। তারপরও শোষিত শ্রেণির হয়ে সবসময় কথা বলে গেছেন, বঞ্চনা ও অধিকারবোধের সকল অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেয়েছে এই মহান ব্যক্তিত্বদের লেখায়।

যার কথা বলছি, তিনি ‘মা’ উপন্যাসটি দিয়ে জগতখ্যাত হয়েছিলেন। যাকে পদে পদে জারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লেখার জন্য কারাবরণ করতে হয়েছিলো ।

শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। প্রথমে জার্মানি, পরে ফ্রান্স হয়ে তিনি পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

বলছিলাম, ম্যাক্সিম গোর্কির কথা। জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ, রাশিয়ার এক অতি দরিদ্র পরিবারে, শহরের নাম নিজনি নভোগরদ।

ম্যাক্সিম গোর্কির আসল নাম এলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেস্কভ। পৈত্রিক নাম ত্যাগ করে ম্যাক্সিম গোর্কি নামধারণ করেছিলেন লেখালেখির স্বার্থে।

এই ছদ্মনাম তাকে এনে দিয়েছিলো বিশ্বজুড়ে খ্যাতি, অথচ তার সমসাময়িক সময়ে ম্যাক্সিম গোর্কিকে আশেপাশের কেউ তো দূরের কথা, তার পরিজনের কেউই তাকে এই নামে চিনতেন না।

রুশ সাহিত্যের অগ্রপথিক; যার লেখা নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বকে

ম্যাক্সিম গোর্কি, ১৯০৬ সালে নেওয়া পোট্রেট

তৎকালীন সাহিত্য জগতে অভূতপূর্ব আলোড়ন ফেলেছিলেন গোর্কি, যার ফলশ্রুতিতে এখনও শ্রদ্ধাভরে মানুষ তার নাম স্মরণ করে। অথচ এই গুণী ও সংগ্রামী মানুষটির জীবন ছিলো অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুর্দশায় জর্জরিত।

ছেলেবেলা কেটেছে অমানুষিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান। তারপর তার মা তাকে নিয়ে যান তার জন্মস্থানের শহর নিজনি নভোগরদে।

বাবা ছাড়া বেড়ে উঠার যত বিড়ম্বনা তার পুরোটার মধ্য দিয়েই বালক এলেক্সেই পার করেছিলেন তার শৈশব, এক সময় মা কেও হারান তিনি।

মা কে হারানোর পর তার জীবনের দুঃখ কষ্টের নতুন অধ্যায় শুরু; নানাবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। কাজ নিলেন ছোট্ট একটি জুতার দোকানে।

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ আর কাজ। বালক এলেক্সেই এই অমানুষিক পরিশ্রম বেশিদিন করতে পারলেন না।

একদিন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে চলে এলেন ভলগার জাহাজঘাটে। নতুন কাজ, থালাবাসন পরিষ্কার করা।

সেখানে এক ব্যক্তি তাকে কিছু পুরনো বই দেন। তারপর থেকেই বই নিয়ে নতুন এক নেশায় মাতলেন এলেক্সেই।

শত অভাব অনটন, কষ্টের মধ্যেও এলেক্সেই বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। কাজ পরিবর্তন করেন একের পর এক। কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারেন নি। যে কাজটিই করতে হতো তাতেই অনেক বেশি খাটিয়ে নেওয়া হতো তাকে।

এসময় তিনি প্রভাবিত হন রুশ কবি পুশকিনের কবিতায়।

বইয়ের নেশায় বুঁদ থাকা এলেক্সেই বই পড়ার ক্ষেত্রে কোন বাছ বিচার রাখতেন না। রুশ কবি পুশকিনের কবিতা তাঁকে লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রচন্ড আগ্রহী করে তোলে।

তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে আকারে ইঙ্গিতে নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন।

পেৎনভ নামে এক যুবকের সাথে পরিচয় হয় তার। এরপরেই বিপ্লবের সাথে যুক্ত হওয়ার মনস্থির করেন এলেক্সেই।

পেশা পরিবর্তন করতে করতে এক সময় রুটির কারখানায় কাজ নেন তিনি। এবারও অমানুষিক পরিশ্রম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ। তবে সহ্য করতে পারেন নি আর।

পশুর মতো পরিশ্রমের ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন আত্মহত্যা করবেন।

এ সময় একটি পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকতেন এলেক্সেই। সেখানে তার মতো আরও নানা শ্রেণির মানুষ থাকতো। তাদের জীবন ছিলো এলেক্সেই এর মতই দুঃখ, দূর্দশা, যাতনায় ভরা। এলেক্সেই এর লেখাগুলোয় এই শ্রেনির মানুষের কাহিনীই উঠে এসেছে ক্রমে।

১৮৮৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। ২০ বছর বয়সী টগবগে যুবক, যে কিনা নিজের জীবন নিয়ে চরমভাবে হতাশ। নিজের বুকে পিস্তল ঠেকালেন, চেপে দিলেন ট্রিগার।

এখানেই ইতি ঘটতো তার জীবনের। মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। বেঁচে উঠার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না।

চিকিৎসকদের হতবাক করে দিয়ে অলৌকিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন এলেক্সেই। এই সুস্থ হওয়ার সময়টায় কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি। ছিলেন সেই রুটির বেকারিতেই। পরে তার হিতাকাঙ্ক্ষী এক বৃদ্ধ তাকে তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান।

আলেকজান্ডার কালুঝনি নামে এক বিপ্লবীর সাথে পরিচয় হয় তার। তারপর থেকেই তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু।

কালুঝনি তাকে মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত করেন। মার্ক্সের রচনা, অর্থনীতি, দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করেন এলেক্সেই।

তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখালেখি শুরু করলেন। কালুঝনির অনুপ্রেরণায় রচনা করলেন নিজের প্রথম লেখা ‘মাকার চুদ্রা’।

১৮৯২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় গল্পটি। এসময়ই তার ম্যাক্সিম গোর্কি নামটি তিনি ব্যবহার করতে শুরু করেন।

‘মাকার চুদ্রা’ এই গল্পটি ছিলো মূলত রোমান্টিসিজম নির্ভর। পরবর্তীতে তার লেখার ধারা হয়ে ওঠে বাস্তবতা ও বিপ্লবকেন্দ্রিক।

‘ছাব্বিশজন পুরুষ ও একটি মেয়ে’, ‘ইজেরগিল’, ‘চেলকাশ’, ‘মালভা’ প্রভৃতি গল্প যুগে যুগে কেড়েছে পাঠকের আগ্রহ, হয়েছে পাঠক সমাদৃত।

‘চেলকাশ’ গল্পটি প্রকাশিত হবার পর বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ভ্লাদিমির গালাক্কিওনচিভচ গোর্কিকে প্রস্তাব দিলেন সাংবাদিকতা করার। বেতন ১০০ রুবল।

Chelkash

‘চেলকাশ’ এর প্রথম প্রচ্ছদ

এরপর থেকেই ম্যাক্সিম গোর্কি লেখক হিসেবে বেশ ভালোভাবে এগোতে থাকলেন।

১৯০০ সালে তার প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘ফোমা গর্দয়েভ’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি রীতিমতো পাঠক সমাজে তুমুল ক্রেজের সৃষ্টি করে। সর্বত্র এটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে শুরু করে।

ম্যাক্সিম গোর্কির প্রথম সার্থক উপন্যাস যা গোটা রাশিয়ায় অভূতপূর্ব সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়।

ম্যাক্সিম গোর্কির কলমের ঝড় তখন সবে শুরু হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অনেক সাধারণ ছাত্র নিহত হয়।

গোর্কি তাদের নিয়ে ‘ঝড়ো পাখির গান’ নামে কবিতা লেখেন। এই কবিতা লেখার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন গোর্কি। তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের সময় তার প্রতি অভিযোগ ছিলো তিনি রাষ্ট্রদোহকে উস্কে দিচ্ছেন। তবে জনরোষের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জার সরকার।

বিখ্যাত নাটক ‘লোয়ার ডেপথ’ এর মঞ্চায়ন, প্রথম দৃশ্য

পরবর্তীতে, ১৯০১ সালে তার বিখ্যাত নাটক ‘লোয়ার ডেপথ’ প্রকাশিত হয়। এবার দেশ ছাড়িয়ে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপেও।

এরপর ‘তারা তিনজন’, ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আম্মা’ এই উপন্যাসগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

একটি সফল লেখকজীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৩৬ সালের ১৮ই জুন। কথিত আছে বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো।

গোর্কি চেয়েছিলেন তার পুত্রের সাথে যেন তার সমাধি হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তা করা হয় নি। বরং স্ট্যালিন ও তার অনুচররা নিজেদের মর্জিমতো সমাধিকার্য সম্পন্ন করেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির সংগ্রামরত প্রথম জীবন, উত্থান ও পরবর্তীতে সফল লেখকজীবন যুবসমাজের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বহুদিন।

তার রচিত ‘মা’ উপন্যাসটি বিশ্বের সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন


এই বিভাগ থেকে পড়ুন