‘হারিকেন’ শব্দের সাথে জরিয়ে কত শত স্মৃতি । এই শব্দটি দেখলে বা শুনলেই ভেসে আসে স্মৃতি জরিত অতীত , সোনালী অতীত বললেও ভূল হবে না । শৈশব থেকে কিশোর বেড়ে উঠা আমার গ্রামে । এই সবটা সময়ের সাথেই হারিকেনের স্মৃতি জরিত ।
আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম, সেই সময় থেকেই শুরু আমার হারিকেন জ্বালানোর দায়িত্ব । মাগরিবের আজানের আগেই হারিকেন জ্বালাতে হতো , দেখতে হতো কেরোসিন আছে কিনা ।
হারিকেন জ্বালিয়ে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় পড়তে বসতাম বাড়ির বারান্দায় । হারিকেনর টিপ টিপ আলোয় পড়তাম আর বাড়ির উঠোনের আম গাছ থেকে আম কুড়াতাম । টিনের চালায় আম পড়ার শব্দে বই রেখে হারিকেন নিয়ে সাবধানতার সাথে দৌড় দেওয়ার চেষ্টায় বারবারই ব্যর্থ হতাম, নিভে যেতো হারিকেন । পড়তে বসার অধিকাংশ সময় আমার দাদু বসে থাকতো আমার পাশে , দাদুর কাজ ছিলো আমের চোকা ছড়ানো । পাড়ার দুই বড় ভাই আসতো বাবার কাছে পড়তে, তাদের ছিলো প্রতিদিনের হারিকেনর আলো নিয়ে হট্টগোল । এদিকে আলো বেশি , আজ আমার হারিকেন আমার দিকে থাকবে । এরকম অনেক সোনালী অতীত মনে পড়ে যায় “হারিকেন” শব্দটির সাথে ।
মাঝরাতে বাহিরে যেতে হলেও ভরসা ছিল এই হারিকেন । তখনকার দিনে শুধু ঘরে নয় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে এ গাঁও থেকে ও গাঁয়ে যেতে লোকেরা হারিকেন বহন করতো। হারিকেন ব্যবহার হতো বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।হারিকেন ছিল মূলত টিনের তৈরি একটি ল্যাম্প বাতির মতো।হারিকেন তৈরি করার কিছু আলাদা মানুষ ছিলো।গঞ্জের হাঁটে হারিকেন কেনা যেতো।
হারিকেন কাঁচের আবরণ বিশিষ্ট একটি আলোর প্রদীপ।গোলাকার একটি কাঁচ পিন্ড যার উপরে ও নিচে আনারসের মতো। নিচের অংশে টিনের তেলের ট্যাংক থাকতো। আর ট্যাংকের ভিতর ঢালা হতো কেরোসিন। পেঁচানো রশি দিয়ে বানানো হতো রেশা, তাছাড়াও গ্রামের দোকানে কিংবা হাটে পাওয়া যেতো হারিকেন ব্যবহারের জন্য বিশেষ এক ফিতা ।
সেই রেশার এক চতুর্থাংশ তেলের ট্যাংকটিতে চুবানো হতো। বাকি এক অংশ কাঁচের উপরে থাকতো।দিয়াশলাই দিয়ে আগুন দিলেই আলো দিতে শুরু করতো হারিকেন। নিচে পাশেই একটি র্যাগুলেটর থাকতো যা দিয়ে হারিকেনর আলো কমানো-বাড়ানো যেতো । উপরের অংশে মোটা তারের একটি হাতল থাকতো। মূলত এই হাতল দিয়ে হারিকেন বহন করা যেত। আগেকার দিনে হারিকেনর ব্যবহার ছিলো অনেক। ছিলোনা কোন টর্চলাইট। গোধূলী বেলা শেষে মানুষের ঘরে আলোকিত করতো এই হারিকেন । হারিকেনে কেরোসিন তেলের ব্যবহার ছিলো বেশ।
গ্রামের দোকানে কেরোসিন বিক্রি হতো । রাতভর ধান ভানা ,ঢেঁকি চালানো এই হারিকেনের আলোয়।তেল কমে এলে আলোও কমে আসতো। তেলের উপর নির্ভর করতো আলোর পরিমাণ।
গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে এক সময় আলোর অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং সবার ঘরে হারিকেন পাওয়া যেত। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটি ঘরের চিত্রটাই তেমনি পাল্টে গেছে। গ্রামীণ সমাজের হারিকেন এখন সোনালী অতীত স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
এক সময়ের আঁধারে আলোর সাথী হারিকেন বিদ্যুৎের দাপটে সমাজের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার হারিকেন। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। রাস্তা-ঘাট,হাঁট- বাজারে এখন বিদ্যুৎের দাপট। বিজ্ঞনের এই মহা আবিষ্কার নিসন্দেহে জাতীর কল্যাণ বয়ে এনেছে। তবে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
এখন হারিকেনের জন্য কেবল সেই গানই মানাই “যখন তোমার কেউ ছিলো না, তখন ছিলাম আমি”
“এখন তোমার সব হয়েছে, পর হয়েছি আমি”।
এই প্রজন্মে বিলুপ্ত প্রায় আগামী প্রজন্মের কাছে হারিকেন ঘুম পাড়ানোর গল্পের মতো হয়ে যাবে।
তবে সময়ের দাবি হচ্ছে আমাদের এসব সোনালী অতিত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। নয়তো এককালের অতিত সম্পর্কে আগামী প্রজন্ম অজানাই থেকে যাবে। সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে এই ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি । তবে এখনো অনেক জায়গায় হারিকেন ব্যবহার করা হয়। নৌকায়, জাহাজের পেছনে সংকেত হিসেবে হারিকেন ব্যবহার করতে দেখা যায়।