ব্যক্তিসত্ত্বার যে সার্থকতা তা মূলত মানুষের সামাজিকতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
মানুষ চায় সমাজে স্বীকৃতি পেতে, নিজের দায়বদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে সম্মানের সাথে সবার কাছে পরিচিত হতে।
মোটেও নয়। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করলে তাকে আদর্শ সমাজ বলা যেতে পারে।
এই সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং এগিয়ে নিতে হলে সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মানুষকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটা সমাজে স্বাভাবিকভাবেই নানারকম মানুষ থাকবে। ধনী, গরিব, সহায়–সম্বলহীন, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে নিয়েই সমাজ।
প্রাচীন সভ্যতাসমূহে সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। বিশেষ করে তিনটি শ্রেণি প্রায় সকল সভ্যতার মাঝেই লক্ষ্য করা যায়। ওই সময়কালীন ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান ছিল। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ সকল প্রকার সুযোগ- সুবিধা ভোগ করতো। কিন্তু সমাজের মধ্য বা নিচু স্তরের মানুষকে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হতো।
কৃষক ও শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী ছিল দারিদ্র্য। অথচ তারাই ছিল সমাজের মেরুদণ্ড।
কেননা তারা অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে মজবুত রাখার জন্য শক্ত ভুমিকা পালন করতো। কিন্তু তাদেরই ন্যায্য অধিকারগুলো তারা পেতো না। কেবল যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে তারাই অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করত।
কৃষক ও দাসদেরকে কাজে বাধ্য করা হতো। শ্রমের দাম ছিল খুব সস্তা।
ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-ফ্রিল্যান্সিং
প্রাচীন গ্রিসে যেখানে নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে সেখানেও এই একই ধরনের শ্রেণি বৈষম্য আমরা দেখতে পাই। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমনভাবে যতগুলো সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাদের প্রত্যেকটিরই একসময় পতন ঘটেছে। পতনের মূল কারণ ছিলো শ্রেণি বৈষম্য। যার উদাহরণ আমরা প্রাচীন বাংলায়ও দেখতে পাই। সেন বংশ পতনের অন্যতম কারণ ছিল শ্রেণিবৈষম্য। সেন শাসকেরা কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ, গন্ধবণিক,মালাকার প্রভৃতি জাতিভেদ সেন যুগে দেখা যায়।
এভাবে সমাজে বহু শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। কাউকে উঁচু আবার কাউকে নিচু শ্রেণি বলে ঘোষণা করে। ফলে বিভেদ ক্রমে বাড়তেই থাকে।
উচ্চ শ্রেণির তথাকথিত রাজা ও জমিদাররা একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই বৈষম্য সেন বংশের পতন ডেকে আনে।
তবে সেই সময় এখন আর নেই। সময় বদলেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের অর্বাচীন সমাজব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে জনকল্যাণের জন্য।
যেখানে শ্রেণিবৈষম্য সেই অর্বাচীন যুগের মতো আর নেই।
বাস্তবতা বলে, এখনও আছে! রাষ্ট্র ,জনকল্যাণমূলক সংগঠন তৈরি হওয়ার পরও আমাদের সমাজে শ্রেণি বৈষম্য লক্ষণীয়। সমাজে উঁচু শ্রেণির মানুষ প্রাচীন কালের মতোই সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। তাদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সমাজের যারা মেরুদণ্ড, অর্থনীতিতে যাদের বড় অবদান তারা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। বিভিন্ন পেশায় লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়া নেওয়ার, লবিং প্রভৃতি বিষয় তো সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে।
সে জন্য যারা যোগ্য, তারা নিয়োগ পাচ্ছে না।
এই অযোগ্য লোকজন যখন বিভিন্ন পেশায় ঢুকছে তখন একদিকে যেমন সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে দেশ ধ্বংসের দিবে ধাবিত হচ্ছে।
শুধু তাই নয়,সমাজে বিভিন্ন পেশার মানুষ বাস করে। কেউ কৃষক, কেউ কারিগর, কেউ শ্রমিক,কেউ শিক্ষক কেউ বা ব্যবসায়ী।
এই পেশার তারতম্যের কারণে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য।
একজন শিক্ষিত ব্যক্তি পাঁচ টাকা ভাড়ার জন্য রিকশাওয়ালার উপর চড়াও হচ্ছেন। নৈতিকতা তাহলে কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে।
যে যার উপর যেভাবে পারছে, সে পেশিশক্তির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করছে।
যত দিন যাচ্ছে তত পেশিশক্তি সমাজে প্রখর আকার ধারণ করছে। দুর্বলরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়,তাদের ধ্বংস হওয়ার অন্যতাম কারণ ছিল শ্রেণিবৈষম্য।
তবে কি আমরাও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বা যাবো ?
সমাজকে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠতে হলে প্রয়োজন আরও সচেতনতা।
সরকারকে নাগরিকের সম- অধিকারের জন্য কঠোর হতে হবে। উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির বিভেদ দূর করতে হবে। সাথে সাথে আমাদেরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।
তবেই একটি সুন্দর, বৈষম্যহীন,আলোকিত সমাজ আমরা গড়তে পারব।