হিমালয় কন্যাখ্যাত শীতপ্রবণ জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় চাষ হচ্ছে শীতের রাজ্যের ফুল টিউলিপ।বিদেশে রফতানিযোগ্য টিউলিপের বাণিজ্য সফল চাষ বদলে দিয়েছে দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের দৃশ্যপট। বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কা-) রোপণের মাত্র ২৩ দিনের মধ্যে উপজেলার সীমান্তঘেঁষা সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আট কিষানির বাগানে ফুটেছে রাজসিক সৌন্দর্যের ফুল টিউলিপ।
ভারত সীমান্তঘেঁষা সারিয়ালজোত-দর্জিপাড়ার টিউলিপ ফুল বাগানগুলো হয়ে উঠেছে একটি দর্শনীয় স্থান। এই গ্রাম দুটির নাম বদলে হয়েছে টিউলিপ গ্রাম। প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ার পর বিদেশী এই ফুলের বাগান দেখতে এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। যারা আসছেন তারা সবাই ৫০/১০০ টাকা করে টিকেট কেটে বাগানে প্রবেশ করছেন। ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিওকলে পরিবারসহ বন্ধুদের দেখাচ্ছেন টিউলিপের সৌন্দর্য্য আবার অনেকে ফোটানো টিউলিপ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ইউটিউবাররাও এ থেকে নেই পিছিয়ে। বাগানে ফোটা ফুলের চাহিদা আর কদর দেখে টিউলিপ চাষের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন অনেকেই।
তেঁতুলিয়ার সারিয়ালজোত-দর্জিপাড়া গ্রামের টিউলিপ বাগানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, শত শত টিউলিপ সারি সারি ফুটে রয়েছে। কয়েক দিন ধরেই একের পর এক ফুটতে শুরু করেছে এই ফুল। ৬ প্রজাতির ১২টি রঙের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফুটেছে বেগুনি, হলুদ, লাল, সাদা, কমলা এই পাঁচ ধরনের ফুল । এই ফুল ফোটাতে উচ্চ কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ফুলগুলো একটি শেডের নিচে চাষ হচ্ছে।
টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও রাতে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে পূর্ণ বয়সের আগে মানসম্মত ফুল নাও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে এবং ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত ফুল স্থায়ী হয়। অনেক সময় আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ব্যতিক্রমও হতে পারে।
পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ উৎপাদনের এ উদ্যোগ নেয় বেসরকারী সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে তেঁতুলিয়া উপজেলাকে নির্বাচন করা হয়।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি উপজেলার সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আয়েশা বেগম, সাজেদা বেগম, মুক্তা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার, হোসনেআরা বেগম, মনোয়ারা ও মোর্শেদার ৪০ শতক জমিতে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কান্ড) রোপণ করা হয়।
ফুলচাষী সাজেদা বেগম বলেন, ঠান্ডার দেশের এই ফুল আমাদের তেঁতুলিয়াতেও হচ্ছে। কারণ এখানেও বেশির ভাগ সময় ঠান্ডা অনুভূত হয়, এ জন্য ভালো টিউলিপ ফুল ফুটেছে। ইএসডিও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীরা এসে বাগান থেকে ফুল নিয়ে যাচ্ছেন। দামও ভাল পাচ্ছি। আগামীতে আরও বেশি জায়গাজুড়ে এ ফুলের চাষ করব।
ইএসডিওর টিউলিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী মোঃ আইনুল ইসলাম বলেন, নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে প্রায় ৬২ টাকা খরচ হয়েছে। পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তী সময়ে বৃহৎ আকারে প্রকল্প হাতে নিয়ে কমপক্ষে এক হাজার চাষীকে দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুলের চাষ সম্প্রসারণ করা হবে। তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইএসডিওর এই টিউলিপ প্রকল্পের এই টিউলিপ চাষ কৃষি বাণিজ্যে ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে দিবে। টিউলিপ ফুলের চাষ দেশে ফুলচাষিদের মাঝে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশে টিউলিপ চাষ সফলভাবে করা সম্ভব। তা আট কিষানি করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের মাটিতে টিউলিপ ফুল ফোটা দেখা আমার এটিই প্রথম। সাধারণত বরফপ্রধান দেশগুলো টিউলিপ ফুলের চাষ হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকায় সেসব দেশে টিউলিপ ভালো ফুটে। কিন্তু বাংলাদেশে টিউলিপ ফুলের চাষ করে এই আট কিষানি অবাক করে দিয়েছেন। আমরা এ নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলবো। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রফতানিযোগ্য পণ্য হিসেবে টিউলিপ ফুলের চাষ করতে পারবে।’তবে যেহেতু এটি শীতপ্রধান দেশের একটি ফুল সেহেতু খুব ভালোভাবে জেনে-বুঝে এ ফুল চাষ করতে হবে।